চিনিশপুর, নরসিংদী
চিনিশপুর কালী মন্দির নরসিংদী জেলার বেশ প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি। সত্যি বলতে গেলে ধর্মীয় সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ একসাথে বসবাস করে। একইসাথে উদযাপন করে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। অন্যান্য ধর্মের ন্যায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও অনেক তীর্থস্থান রয়েছে এদেশে।
বাংলাদেশে অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নানাবিধ তীর্থস্থানের মধ্যে অন্যতম একটি পুণ্যতীর্থ হলো নরসিংদী জেলায় অবস্থিত শ্রী শ্রী চিনিশপুর কালী মন্দির। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সনাতন ধর্মালম্বীরা এই মন্দিরে দেবী দর্শনে আসে। এখানে এসে তারা দেবীর আরাধনা করে, পূজো দেয়, মানত করে, নবজাতকের নামকরণ ও অন্নপ্রাশনের মতো বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
অনুমান করা হয় যে, ১৭৬০ সালে এই চিনিশপুর কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। দ্বিজ রামপ্রসাদ নামের একজন বীর সাধক এই কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সাধক দ্বিজ রামপ্রসাদ ‘চিন ক্রম’ নামের সাধন প্রণালীতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সেই থেকেই কালক্রমে এই গ্রামটির নাম হয় চিনিশপুর। দ্বিজ রামপ্রসাদ নাটোরের মহারাজা রামকৃষ্ণ রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। দেবীর অনুগ্রহ লাভ ও আদেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি চিনিশপুর গ্রামে আসেন এবং গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে আশ্রয় লাভ করেন।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা হাড়িধোঁয়া নদীর দক্ষিণ তীরে সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে অবস্থিত এই কালী মন্দিরটি ছায়া সুনিবিড় নির্জন পরিবেশে গড়ে উঠেছে। কালীবাড়ীর মূল আকর্ষণ হচ্ছে প্রায় এক একর জমির উপর বেড়ে উঠা বিশালাকার একটি বট বৃক্ষ। এই বট বৃক্ষটির নিচেই পঞ্চমুখী আসন প্রস্তুত করে ইষ্ট দেবতার কৃপা লাভের জন্য সাধনা শুরু করেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক এবং বৈশাখ মাসের অমাবস্যা তিথিতে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। দ্বিজ রামপ্রসাদের সিদ্ধি লাভের পর থেকেই বট বৃক্ষটি জনসাধারণের নিকট তীর্থকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। প্রতিদিন হাজারো নর-নারী বট বৃক্ষের নিচে সাধু দর্শনের জন্যে ভিড় করতে থাকেন। আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে সাধক দ্বিজ রামপ্রসাদ জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ইষ্ট দেবতার নামে দক্ষিণা কালী মূর্তি স্থাপন করেন। তখন থেকেই এ মন্দিরটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে আসছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গেছে, নরসিংদীর এই চিনিশপুর কালীবাড়ির বয়স ২৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সে হিসাবে এই মন্দিরের বটবৃক্ষটির বয়স ৩০০ বছরের কম হবে না।
প্রথম ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ যতীন্দ্র মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রী শ্রী চিনিশপুর কালী মন্দিরের অনেক ইতিহাস জানা যায়। বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় নির্জন কালীবাড়ীতে বট বৃক্ষের নিচে বসে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, লাঠিখেলা, ছোড়াখেলা ও কুস্তিখেলার আয়োজন করা হতো। বিপ্লবীরা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেয়ার দীক্ষা নিতেন।
একসময় এই শ্রী শ্রী চিনিশপুর কালীবাড়ীর অদূরেই অবস্থিত ছিলো বৃটিশ নীলকরদের নীলকুঠি। এই নীলকুঠি থেকে তারা আশেপাশের জমির কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করার অমানবিক কার্যক্রম চালাতো। বর্তমানে অবশ্য সেই নীল কুঠির ভাঙ্গা ভিটা ও পরিত্যক্ত ইঁদারা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নীলকর জেমস ওয়াইজের দেওয়ান রামকৃষ্ণ রায় বর্তমান কালী মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।
চিনিশপুর কালী মন্দিরকে ঘিরে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। শোনা যায়, একবার নাকি দেবী কালী তাঁর হাত পুকুরে দেখিয়ে তার ভক্তকে বলেছিলেন দেখ তোর দেওয়া শাঁখা আমি হাতে পরেছি। এছাড়াও এই কালী মন্দিরকে নিয়ে আরও অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত আছে।
চিনিশপুর কালী মন্দিরের প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানমালায় সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় পূজা-অর্চনা, ভোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও, ভক্তদের অনুষ্ঠান হিসেবে অন্নপ্রাসন এবং সেবার আয়োজন করা হয়। বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের ১ম অমাবস্যায় কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষ্যে তিথি অনুসারে এক অথবা দুইদিনব্যাপী বিরাট মেলার আসর বসে।
মন্দিরের জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে আট বিঘা। নির্মাণাধীন সুন্দর, মনোরম মন্দিরসহ ছোট্ট গাভী, বেশ কয়েকটি বিশ্রামাগার ও সেবার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে মন্দিরটিতে। প্রায় দুই বিঘা আয়তনের একটি বিশাল পুকুর রয়েছে কালীবাড়ির অভ্যন্তরে। তবে ভক্ত-তীর্থযাত্রীদের রাত্রিযাপনকল্পে থাকার সুব্যবস্থা নেই। ৮ বৎসর যাবৎ নকশা অনুযায়ী মন্দির নির্মাণ, উন্নয়ন, বাউন্ডারী সীমানা নির্মাণে ভক্তদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ মন্দির নির্মাণে আরও পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকার মহাখালি থেকে পি.পি.এল সুপার (ভাড়া জনপ্রতি ৯৫ টাকা) বাসে নরসিংদী ভেলানগর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামতে হবে। এছাড়া ট্রেনেও নরসিংদী যাওয়া যায়। নরসিংদী রেল স্টেশনে নেমে সেখান থেকে ইজি বাইক বা রিক্সায় করে ভেলানগর বাস স্ট্যান্ড পৌছাবেন। তারপর এখান থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার পশ্চিমে ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী চিনিশপুর কালীবাড়ী মন্দিরের অবস্থান। ভেলানগর বাসস্ট্যান্ড থেকে পায়ে হেঁটে বা অটো কিংবা রিক্সায় চড়ে শ্রী শ্রী চিনিশপুর কালীবাড়ীতে যাওয়া যায়। এছাড়াও পলাশ উপজেলার চরনগরদি বাইপাস থেকে ১ কিলোমিটার পূর্বদিকে ১৫ মিনিটের রাস্তা ধরে এগোলেও মন্দিরে যাওয়া যায়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস